স্ট্রিট আর্ট: দেয়ালজুড়ে রঙিন প্রতিবাদ ও সৃজনশীলতার গল্প
ভূমিকা: শহরের দেয়ালে শিল্পের নিঃশব্দ ভাষা
আপনি যখন ব্যস্ত কোনো শহরের রাস্তায় হাঁটছেন, হঠাৎ একটি দেয়ালে আঁকা চমৎকার চিত্র চোখে পড়ল—সেখানে হয়তো একটি মুখ হাঁ করছে, কেউ প্রতিবাদ করছে, কেউ হাসছে। আপনি থেমে যান, দেখেন, ভাবেন। এটি হচ্ছে স্ট্রিট আর্ট—নীরব অথচ প্রভাবশালী এক শিল্পমাধ্যম, যা দেয়ালকে করে তোলে ক্যানভাস।
স্ট্রিট আর্ট শুধুই আঁকা নয়, এটি হচ্ছে কথা বলার এক অভিনব রীতি। এই শিল্প আমাদের বলে দেয় সমাজের না বলা কথা, দেয় প্রতিবাদের ভাষা, তুলে ধরে সংস্কৃতির পরিচয়। আজ আমরা জানব এই স্ট্রিট আর্টের জন্ম, বিস্তার, রূপভেদ, সামাজিক গুরুত্ব, প্রযুক্তির ভূমিকা এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এর উত্থান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে বিস্তারিত।
স্ট্রিট আর্টের ইতিহাস: দেয়ালের গায়ে লেখা প্রথম গল্প
স্ট্রিট আর্টের ইতিহাস বহু পুরনো, তবে আধুনিক স্ট্রিট আর্টের যাত্রা শুরু হয় ১৯৬০-এর দশকে আমেরিকার নিউ ইয়র্ক শহরে। তরুণেরা তখন সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে দেয়াল ব্যবহার শুরু করে।
তাদের প্রথম প্রকাশ ছিল গ্রাফিতি—যেখানে নিজের নাম, গ্যাং সাইন বা মেসেজ ছড়িয়ে দেওয়া হতো স্প্রে পেইন্ট দিয়ে। ধীরে ধীরে এই “অবৈধ” কার্যকলাপ রূপ নেয় এক নতুন শিল্পরূপে, যা কেবল শহরের সৌন্দর্য নয়, বরং সমাজের মনের ভাব প্রকাশের মাধ্যম হয়ে ওঠে।

সময়ক্রমে স্ট্রিট আর্ট:
- ১৯৭০: Subway Art, Graffiti Culture এর বিকাশ।
- ১৯৮০: Banksy, Jean-Michel Basquiat-এর মতো শিল্পীর উত্থান।
- ২০০০: স্ট্রিট আর্ট একটি গ্লোবাল ট্রেন্ডে পরিণত হয়।
স্ট্রিট আর্টের ধরন ও বৈচিত্র্য
স্ট্রিট আর্ট কেবল একক ধরণের নয়। এটি বিভিন্ন শৈলীতে ও রীতিতে প্রকাশ পায়।
গ্রাফিতি (Graffiti)
স্প্রে পেইন্ট ব্যবহার করে রঙিন লেখা বা প্রতীক আঁকা। অনেক সময় গ্যাং-এর পরিচয় বা রাজনৈতিক বার্তা দেওয়া হয়।
স্টেনসিল আর্ট (Stencil Art)
টেমপ্লেট ব্যবহার করে আঁকা ছবি, যা দ্রুত দেয়ালে প্রতিস্থাপন করা যায়।
পেস্ট-আপ (Paste-Up)
কাগজে ছাপানো ছবি বা বার্তা দেয়ালে আঠা দিয়ে লাগানো হয়। এটি হালকা কিন্তু প্রভাবশালী মাধ্যম।
মুরাল (Mural)
বড় মাপের দেয়ালচিত্র। এটি সরকারি বা বেসরকারি অনুমতি নিয়ে করা হয়। বেশিরভাগ সময় সমাজ, সংস্কৃতি ও ইতিহাস তুলে ধরা হয়।
ইনস্টলেশন আর্ট
তিন-মাত্রিক ভাস্কর্য বা অবজেক্ট রাস্তার পাশে স্থাপন করা হয়। অনেক সময় হঠাৎ দেখা যায় সড়কের পাশে বিশাল একটি চোখ বা মস্তিষ্ক!
বিশ্বজুড়ে স্ট্রিট আর্টের উজ্জ্বল উপস্থিতি
বিশ্বের নানা শহরে স্ট্রিট আর্ট এক বিশাল সাংস্কৃতিক রূপ নিয়েছে:
নিউ ইয়র্ক
গ্রাফিতির জন্মস্থান। এখানে সাবওয়ে ট্রেন, দেয়াল, টানেল সবই যেন শিল্পের ক্যানভাস।
লন্ডন
Banksy-এর মতো বিখ্যাত শিল্পীর কাজ ছড়িয়ে আছে শহরজুড়ে। তার শিল্প সমাজ, রাজনীতি ও যুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়।
বার্লিন
বার্লিন ওয়ালের স্ট্রিট আর্ট বিশ্ববিখ্যাত। সেখানে শিল্পীরা স্বাধীনতা ও ঐতিহাসিক বার্তাগুলো তুলে ধরেন।
সাও পাওলো
ব্রাজিলের এই শহরে রঙে ভরা স্ট্রিট আর্ট স্থানীয় সংস্কৃতি, ফুটবল এবং সামাজিক আন্দোলনের প্রতিচ্ছবি।
বাংলাদেশে স্ট্রিট আর্ট: নতুনতর শিল্পের উত্থান

বাংলাদেশে স্ট্রিট আর্টের যাত্রা তুলনামূলকভাবে নতুন হলেও এর প্রভাব বিস্তৃত হচ্ছে। বিশেষ করে:
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা: এখানে শিক্ষার্থীরা দেয়ালে প্রতিবাদী বক্তব্য লিখে থাকেন, শিল্পের মাধ্যমে সামাজিক বার্তা দেন।
- বিউটি বোর্ডিং এলাকা, পুরান ঢাকা: দেয়ালজুড়ে মুরাল আর্ট সমাজ, ইতিহাস ও সংস্কৃতি তুলে ধরেছে।
- সামাজিক বার্তাবহ দেয়ালচিত্র: “নিরাপদ সড়ক চাই”, “রক্ত দান করুন”, “নারী নির্যাতন বন্ধ করুন”—এমন নানা বার্তায় ভরা রয়েছে অনেক দেয়াল।
স্ট্রিট আর্ট: প্রতিবাদের ভাষা
স্ট্রিট আর্ট কেবল সৌন্দর্য নয়, বরং এটি সমাজের প্রতিবাদের মাধ্যম।
- যুদ্ধ ও সহিংসতার বিরুদ্ধে বার্তা
- নারীর অধিকার রক্ষা
- পরিবেশ সংরক্ষণ
- রাজনৈতিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
Banksy-এর কাজ এর বড় উদাহরণ, যেখানে তিনি যুদ্ধ, শিশু শ্রম, সমাজের অবিচার ইত্যাদি বিষয়ে সরাসরি চিত্র তুলে ধরেন।
স্ট্রিট আর্ট ও প্রযুক্তির যুগ
বর্তমানে স্ট্রিট আর্ট কেবল রঙতুলির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। প্রযুক্তি এতে যুক্ত হয়ে শিল্পকে করেছে আরও ইন্টারঅ্যাকটিভ।
- AR স্ট্রিট আর্ট: মোবাইল ফোন দিয়ে দেখলে শিল্প জীবন্ত হয়ে ওঠে।
- ডিজিটাল প্রজেকশন: ভবনের গায়ে প্রজেক্টর দিয়ে মুভিং আর্ট দেখানো হয়।
- 3D আর্ট: চোখের ভ্রান্তি তৈরি করে বাস্তবের মতো মনে হয়।
স্ট্রিট আর্ট ও তরুণ প্রজন্ম
তরুণরাই এই শিল্পের প্রাণ। তারা দেয়ালে তুলে ধরে তাদের চিন্তা, প্রতিবাদ, ভালবাসা, হতাশা।
বিশ্বব্যাপী স্ট্রিট আর্ট ফেস্টিভালগুলোতেও তরুণদের অংশগ্রহণ বিশাল। বাংলাদেশেও এমন আয়োজনের সংখ্যা বাড়ছে।
স্ট্রিট আর্ট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম
সোশ্যাল মিডিয়া যেমন ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক স্ট্রিট আর্টের প্রচারকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। একজন শিল্পী এক জায়গায় কাজ করলেও সারা পৃথিবী তা দেখতে পায়।
স্ট্রিট আর্ট ও আইনি বাঁধা
অনেক দেশে স্ট্রিট আর্টকে অবৈধ ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ হিসেবে ধরা হয়। আবার কিছু দেশ/শহর এটিকে আইনি স্বীকৃতি দিয়েছে।
বৈধ স্ট্রিট আর্ট:
- অনুমতি নিয়ে করা দেয়ালচিত্র
- স্থানীয় সরকার অনুমোদিত প্রকল্প
অবৈধ স্ট্রিট আর্ট:
- গোপনে করা গ্রাফিতি
- প্রাইভেট প্রপার্টিতে অনুমতি ছাড়া আঁকা
বাংলাদেশে স্ট্রিট আর্টের ভবিষ্যৎ
- চিত্রশিল্পীদের উৎসাহ প্রয়োজন
- নগর কর্তৃপক্ষের সহায়তা দরকার
- স্ট্রিট আর্ট ফেস্টিভালের আয়োজন বাড়ানো দরকার
- নতুন প্রজন্মকে প্রশিক্ষণ ও সুযোগ দেওয়া জরুরি
FAQ: স্ট্রিট আর্ট সম্পর্কে প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন
১. স্ট্রিট আর্ট কী?
স্ট্রিট আর্ট হলো একটি দৃশ্যমান শিল্পমাধ্যম যা জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়, সাধারণত দেয়াল বা সড়কের উপর।
২. স্ট্রিট আর্ট কি অবৈধ?
কিছু দেশে অনুমতি ছাড়া করলে তা অবৈধ ধরা হয়। তবে অনুমতি নিয়ে করা হলে তা আইনসিদ্ধ।
৩. স্ট্রিট আর্ট কারা করে?
বেশিরভাগ সময় তরুণ শিল্পীরা এটি করেন, তবে অনেক বিখ্যাত পেশাদার শিল্পীও এখন স্ট্রিট আর্টে জড়িত।
৪. বাংলাদেশে কোথায় কোথায় ভালো স্ট্রিট আর্ট দেখা যায়?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, পুরান ঢাকা, আর্ট ফেস্টিভাল এলাকা, বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের কেন্দ্রস্থলগুলোতে।
৫. স্ট্রিট আর্ট কেন গুরুত্বপূর্ণ?
এটি সমাজের অব্যক্ত কথাগুলো প্রকাশ করে। এটি প্রতিবাদের ভাষা, সংস্কৃতির প্রতিফলন, এবং তরুণদের চিন্তার বহিঃপ্রকাশ।
উপসংহার: দেয়ালে জীবনের গল্প
স্ট্রিট আর্ট কেবল একটি আর্ট ফর্ম নয়—এটি মানুষের অনুভব, সমাজের বাস্তবতা, এবং শিল্পের শক্তির প্রতিচ্ছবি। দেয়ালের গায়ে আঁকা প্রতিটি রঙ আমাদের নতুন করে ভাবায়, দেখায়, শেখায়। আপনি যখন আবার কোনো স্ট্রিট আর্ট দেখবেন, থেমে একটু ভাবুন—দেয়ালটি হয়তো কিছু বলছে আপনাকে।